ADAB – Association of Development Agencies in Bangladesh

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান যৌন হয়রাণী, ভাবনা ও প্রতিকার।

- কাউসার আলম কনক, কর্মসূচি পরিচালক, এডাব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান যৌন হয়রাণী, ভাবনা ও প্রতিকার ২
সাম্প্রতিককালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রাণী আশংকাজনকহারে বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে দেশের কোন না কোন অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রাণীর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এসব যৌন হয়রাণী প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহর কোন জায়গার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। ফলে একদিকে শিক্ষাঙ্গণে নারী শিক্ষার্থীরা যেমন নিরাপত্তাহীন, অন্যদিকে অভিভাবকগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে আতঙ্কিত। তারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে সাহস পায় না।
সাম্প্রতিককালে দেশের কয়েকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রাণীর কয়েকটি ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর অভিভাবকেরা আরো বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো গ্রামের তুলনায় শহরের নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রাণীর মাত্রা তুলনামূলক বেশী। একথা সত্য যে, সংঘটিত যৌন হয়রাণী বা নারীর শ্লীলতাহাণীর ঘটনা কিন্তু সাধারণত লোকলজ্জা বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে ভুক্তভোগীরা চেপে যায় বা প্রকাশ করতে চায় না। গণমাধ্যমে যা প্রকাশ হয়, তা সংঘটিত ঘটনার তুলনায় খুব কম। সাম্প্রতিক সময়ে এক সমীক্ষায় দেখা দেখে গেছে সারাদেশে সংঘটিত যৌন হয়রাণীর শতকরা ১০% ভাগেরও কম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বাকী ৯০% ভাগই রয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রকাশিত শতকরা ১০% ভাগের ফলেই আমরা আতঙ্কিত এবং ভীত।
তাহলে, দেশের শিক্ষাঙ্গণসমূহের প্রকৃত অবস্থা কি, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও যৌন হয়রণীর বিষয় প্রকাশের অনুকুলে না। এসব বিষয় প্রকাশিত হলে কিংবা যৌন হয়রাণীর বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে, ন্যায় বিচার পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগীকেই আরো নাজেহাল হতে হয়। সমাজ ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করে, আর আইনের শাসন, সে-তো সুদূর পরাহত। বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যে সকল আইনেই, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তাকেই প্রমান করতে হয় যে, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সাথে তিনি সম্পৃক্ত নয়। কিন্ত একমাত্র আইন, যে আইনে যিনি যৌন হয়রাণী বা ধর্ষণের শিকার তাকেই প্রমান করতে হয় যে, তিনি ধর্ষণের শিকার।
আবার যৌন হয়রাণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে কিংবা আদালতে মামলা করলেও উপযুক্ত প্রমানের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায় পাওয়া সম্ভব হয়না। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর আত্মহত্যা তারই উদাহরণ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোচিং সেন্টার সমূহে এসব অপকর্মের সাথে কতিপয় বিবেকবর্জিত শিক্ষক, কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা সম্পৃক্ত থাকলেও, উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে এর সাথে যুক্ত হয় একশ্রেণীর বিকৃত মস্তিৃকের শিক্ষার্থী। যারা আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশীনদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। যার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষাঙ্গণে যৌণ হয়রাণীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোাগের যথাযথ বিচার হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিতেই দিনকে দিন শিক্ষাঙ্গণে যৌন হয়রাণীর মাত্রা বেড়ে চলেছে। একারণে আজ অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান যৌন হয়রাণী, ভাবনা ও প্রতিকার
অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানবিক গুনাবলী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরীর কারখানা। এসব কারখানায় কর্মরত শিক্ষকেরা হলেন প্রধান কারিগর। যেকোন একটি দেশের সুস্থ্য বিবেক, মানবিক গুনাবলী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার শক্তি সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরী করা এসব কারিগরদের দায়িত্ব। যুগযুগ ধরে সারাবিশ্বে শিক্ষক সমাজই এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্ত বর্তমানে কিছু অর্থলোভী, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষক নামধারী লোক শিক্ষকতার ন্যায় মহান পেশাকে অর্থ উর্পাজন ও ব্যাক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করার ক্ষেত্র হিসাবে শিক্ষাঙ্গনকে বেছে নিয়েছে। তারাই শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে হিসাবে ব্যবহার করছে এবং শিক্ষাঙ্গনকে যৌন হয়রাণীসহ নারীর মর্যাদাহানীর মত কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ছাত্র নামধারী কিছু শিক্ষার্থী। তাদের নোংরা লালসা থেকে কেবল নারী শিক্ষার্থীরাই নয়, অনেক সময় শিক্ষার আলো বিতরণে নিয়োজিত নারী শিক্ষকেরাও রেহাই পায় না। নারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নারী শিক্ষকরাও আজ শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ নয়। তারাও এসব লম্পট নীতি-নৈতিকতা বিরোধী শিক্ষকদের কামনা-বাসনা থেকে রক্ষা পায়নি।
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে সারাবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও মানবসম্পদে পরিণত করে তাদেরকে কর্মক্ষেত্রের উপযুক্ত স্থানে নিয়োগ দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে কাজ করে চলেছেন, যেখানে শিক্ষাঙ্গণে যৌণ হয়রাণী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নারীর মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিতকরণে অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে নারী। এই নারীদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে হলে তাদেরকে শিক্ষায়, দক্ষতায় যথোপযুক্ত করে তুলতে হবে। সেইভাবেই পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গণের অনৈতিক ও নারীর মর্যাদাহানীকর কর্মকান্ড নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে শিক্ষাঙ্গণে যৌন হয়রাণী প্রতিরোধ সময়য়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রাণী বা নারীর প্রতি মর্যাদাহাণীকর আচরণের অভিযোগ উঠেছে, তা নিরপেক্ষ, প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে, অভিযোগ প্রমানিত হলে, তাদের বিরুদ্ধের কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনাটি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা প্রয়োজন। তদন্তে যেই দোষী প্রমানিত হবে, তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এইক্ষেত্রে যেন কোন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা ক্ষমতার কোন প্রভাব না পড়ে।
শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ অনুমোদনের ক্ষেত্রে তাদের অতীত কর্মকান্ড সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিগণ নারী অধিকার, নারীর মর্যাদা ও নারীর স্বাধীন পেশা বা চলাফেরার প্রতি সংবেদনশীল কি-না। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। গঠিত টাস্কফোর্সকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top